বাংলা হান্ট ডেস্ক: কঠোর পরিশ্রম করলে জীবনে সফলতা আসবেই। অনেকের ক্ষেত্রে সেই সাফল্যের স্বাদ পেতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়, আবার অনেকে তা পেয়ে যান একদম অল্প বয়সেই। বাইশ বছর বয়সে, যখন বেশিরভাগ যুবক তাঁদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সেখানে এই যুবক নিজের কোম্পানি তৈরি করে সুযোগ করে দিচ্ছেন কর্মসংস্থানের।
বর্তমান প্রতিবেদনে আমরা যাঁর বিষয়ে আলোচনা করব তিনি হলেন হিরন্ময় গগৈ। মাত্র বাইশ বছর বয়সেই তিনি পৌঁছে গিয়েছেন সফলতার শীর্ষে! যদিও, তাঁর এই যাত্রাপথ মোটেও সুগম ছিলনা। বরং সেখানে রয়েছে এক যুদ্ধের কাহিনি।
“হিরন্ময়” নামটির অর্থ হল “স্বর্ণালী”। নামের মতই হিরন্ময় হলেন একজন প্রকৃত সহানুভূতিশীল এবং দয়ালু ব্যক্তি যিনি সবসময়ই ভেবেছেন সাধারণ মানুষদের জন্য। হিরন্ময়ের বয়স যখন পনেরো, তখন তাঁর ভাই এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। শুধু তাই নয়, ২০১২ সালে তাঁর মা’ও পরলোকগমন করেন।
হিরন্ময়ের মা প্রায় ১৩ বছর ধরে এক দুরারোগ্য ব্যাধির সাথে লড়াই করছিলেন। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি হিরন্ময়কে এক গভীর আঘাত দেয়। এমনকি, তিনি অবসাদগ্রস্থও হয়ে পড়েছিলেন। এদিকে, তাঁর বাবা আবার একবার বিয়ে করেন।
যদিও, এই ঘটনার পর হিরন্ময় নতুন মা’কে তাঁর মায়ের স্থান দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করলেও তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর নিজের মায়ের মত কেউই হতে পারবেন না। তাই, মন খারাপ করলে তিনি নিজের সাথে কথা বলতেন। এমনই এক স্ব-কথোপকথনের সময় হিরন্ময় নিজেকে বুঝিয়ে ছিলেন যে, তিনি এভাবে আর জীবনযাপন করবেন না। পাশাপাশি, তিনি নিজের কাছে শপথ নিয়েছিলেন, তিনি নিজেকে এই কষ্ট থেকে বের করে আনবেন এবং তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্যদের সাহায্য করবেন।
এখান থেকেই তার মনে একটি “ফুড-টেক”-এর ধারণা জন্মেছিল। এটি সাধারণত গ্রামীণ প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত একটি অনলাইন ব্যবসার ধারণা ছিল। এই ব্যবসার মূল কেন্দ্র আসামে অবস্থিত হলেও এর শাখাগুলি সর্বত্র কাজ করছে। হিরন্ময় বিশ্বাস করেন যে, এই ব্যবসা কৃষকদের জন্য প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করবে।
হিরন্ময় তাঁর ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেন। তিনি “গাঁও কা খানা” নামের একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছেন যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই যা চান তা পেতে পারেন। এই অ্যাপটির সাতটি বিভাগ রয়েছে। এর অধীনে আলাদা আলাদা বিভাগে বিভিন্ন ধরণের মেনু এবং পছন্দের তালিকা রয়েছে। সেগুলি হল:
১. “গাঁও কা খানা” ঐতিহ্যবাহী স্টাইল: এতে আসামের গ্রাহকদের সেখানকার ঐতিহ্য অনুযায়ী খাবার পরিবেশন করা হয়।
২. “গাঁও কা খানা” পার্টি স্টাইল: এতে লোকেরা পার্টির জন্য পশ্চিমী খাবারের অর্ডার দিতে পারেন।
৩. “গাঁও কা খানা” প্রাকৃতিক স্টাইল: এতে গ্রাহকরা অর্গানিকভাবে উৎপাদিত সবজি অর্ডার করতে পারবেন। এই ব্যবসায় কৃষকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা হয় এবং সবজি ও ফল গ্রাহকদের বাড়িতে জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়া হয়।
৪. “গাঁও কা খানা” “মন্দিতা”: এটি তাঁর মায়ের নামের উপর ভিত্তি করে তৈরি। এতে অন্যান্য ধরনের খাদ্য সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
৫. গাঁও কা খানা” স্থানীয় স্টাইল: এটি আসামের স্থানীয় পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
৬. “গাঁও কা খানা” আবাসন স্টাইল: এতে আসামের হোটেলে বুকিংয়ের সুবিধা প্রদান করা হয়।
৭. “গাঁও কা খানা” সম্পর্ক মোড: এতে দম্পতিরা তাদের হোটেল বুকিং সম্পন্ন করতে পারেন।
পাশাপাশি, “গাঁও কা খানা” শুরু করেছে “কৃষি বিকাশ যোজনা”। এতে কৃষকদের “গাঁও কা খানা”-এ নিবন্ধন করতে হয় এবং তাঁদের একটি কার্ডও দেওয়া হয়। গ্রাহকরা যখন অর্ডার দেন, তখন কৃষকদের জৈব চাষ থেকে প্রস্তুত সবজি এবং ফল, গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয় এর মাধ্যমে। এই কার্ডের খরচ প্রতি মাসে মাত্র ১ টাকা। এই প্রচেষ্টার নাম FFL (Fresh From Land)। যেসব কৃষক গ্রাম থেকে শহরে বারবার যেতে পারেন না, তারা “গাঁও কা খানা”র অফিসে সবজি পৌঁছে দেন।
হিরন্ময় ২০১৬ সালের জুন মাসে মাত্র ১০ টাকা দিয়ে তাঁর ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর গ্রাম শিবসাগর থেকে ডেলিভারির জন্য শহরে যাওয়া সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলেও তিনি কখনোই এই বাধাগুলিকে তাঁর ব্যবসাকে প্রভাবিত করতে দেননি।
ইতিমধ্যেই হিরন্ময় গগৈকে “ষষ্ঠ ক্ষুদ্র ও উদীয়মান ব্যবসা-২০১৭”-এ জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির জেরে মাত্র ২২ বছর বয়সে হিরন্ময় যেভাবে সফল হয়েছেন তা নিঃসন্দেহে সকলকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। পাশাপাশি, ইচ্ছে থাকলেই যে উপায় হয় তা আরও একবার প্রমাণ করেছেন হিরন্ময়।