বাংলা হান্ট ডেস্কঃ বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারকে (Liton Halder) কদর্য ভাষায় হুমকির অভিযোগ অনুব্রত মণ্ডলের (Anubrata Mondal) বিরুদ্ধে। বর্তমানে এই ইস্যুতে সরগরম গোটা বাংলা। তৃণমূল নেতার এহেন আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছে নানান মহল। এই আবহে বাংলা হান্টের কাছে মুখ খুললেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী (Bidyut Chakraborty)। ভাগ করে নিলেন, কীভাবে একসময় কেষ্টর দাপট সহ্য করেছেন তিনি। বিদ্যুৎবাবু বলেন, ‘বহুবার গালিগালাজের সম্মুখীন হয়েছি, মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে’।
অনুব্রতর (Anubrata Mondal) ‘কীর্তি’ ফাঁস করলেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য
বিশ্বভারতীর উপাচার্য থাকাকালীন একাধিকবার সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। তাঁকে ২১ দিন ‘বন্দি’ করে রাখার কথা এখনও হয়তো অনেকের মনে আছে। তবে শুধু এই একটি ঘটনা নয়, নানান সময়ে বহুবার অনুব্রতর অত্যাচার সয়েছেন বিদ্যুৎবাবু। এদিন বাংলা হান্টের কাছে এমনই কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেন তিনি।
বিদ্যুৎবাবু শুরুতেই রাজ্যবাসীকে ধন্যবাদ জানান। আইসি-কে হুমকি কাণ্ডে অনুব্রতকে (Anubrata Mondal) নিয়ে নানান মহল থেকে যে ধরণের মন্তব্য উঠে আসছে, তাতে বাঙালি হিসেবে ভালো লাগছে বলে জানান তিনি। এরপরেই নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য।
আরও পড়ুনঃ কলকাতা ছুটতে হবে না, এবার হুগলি-বর্ধমান থেকে নামমাত্র খরচে দিঘা! চালু হল সরাসরি বাস পরিষেবা
বিদ্যুৎবাবু বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। কারণ অনুব্রত মণ্ডল এই ধরণের মানুষ, তিনি যে সবার সঙ্গে কদর্য ব্যবহার করবেন, এটা খুব সহজেই অনুমেয়, তাই না?’
বিশ্বভারতীর (Visva Bharati University) প্রাক্তন উপাচার্য বলেন, বহুবার তিনি গালিগালাজের সম্মুখীন হয়েছেন। ফোনে বহুবার গালিগালাজ, হুমকি দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রাণে মেরে ফেলার ধমকিও দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। বহুবার ‘পাগল’ও বলা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
বিদ্যুৎবাবু বলেন, ‘বিশ্বভারতীর মেলাপ্রাঙ্গনের একটা দিকে একটা গেট ছিল। সেটি হেরিটেজ গেট ছিল। সেই গেট জেসিবি মেশিন দিয়ে ভাঙা হয়। যেদিন এটা করা হয়েছিল, তার আগে অনুব্রত মণ্ডল আমায় ধমকি দেন, আমি গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক নিয়ে আসব…। যেদিন ঘটনা ঘটে, সেদিন বাস, টোটো, ট্রাক্টর, বাইকে চেপে কয়েক হাজার লোক এসেছিল। তিন ঘণ্টা ধরে সেই তাণ্ডব হয়। তার নেতৃত্বে ছিলেন অনুব্রত মণ্ডল তবে ময়দানে নেমেছিলেন বীরভূম জেলার এক প্রাক্তন বিধায়ক ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। মেলা প্রাঙ্গনে তাণ্ডব চালিয়ে সব কিছু ভাঙার পর সিমেন্ট, বালি, সাইকেল, ঘাস কাটার যন্ত্র ইত্যাদি চুরি করে নিয়ে যায়’।
বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য জানান, সেই সময় প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন, তবে পুলিশ ফোন ধরেনি, তারা আসেননি। ৩ ঘণ্টা পর পুলিশ ফোন ধরে জানায়, আমাদের কিছু করার নেই। কারণ যেখান থেকে আদেশ এসেছে, সেই আদেশ ভঙ্গ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। বীরভূম জেলায় পুলিশের সবচেয়ে বড় আধিকারিক একথা বলেছিলেন বলে দাবি করেন বিদ্যুৎবাবু।
এরপর ২১ দিন ‘বন্দি’ করে রাখার ঘটনা নিয়ে মুখ খোলেন তিনি। বলেন, ‘অনুব্রত মণ্ডলের আদেশ ছিল, অফলাইনে ক্লাস হবে কিন্তু অনলাইনে পরীক্ষা হবে। কিন্তু আমি বলেছিলাম, বিশ্বভারতীর উপাচার্য তো আমি। কী করা উচিত আমরা ঠিক করব। আর অফলাইন ক্লাস হলে পরীক্ষাও অফলাইন হবে। কিন্তু সেটা ওনার মনঃপুত ছিল না বলে ওনার সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে আমায় ২১ দিন বন্দি করেন। শেষ দিকে লাইট ও জলের সংযোগ কেটে দেয়। আমার ঘরে শুধুমাত্র চাল পড়েছিল। ভাত সেদ্ধ করে বেঁচে ছিলাম… পুলিশ আমায় বাঁচায়নি। আমায় বাঁচিয়েছিলেন, কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি রাজশেখর মান্থা। ওনার রায়ের ফলে ২১ দিন পর পুলিশ এসে আমায় উদ্ধার করে। এটাও আমার প্রতি অনুব্রত মণ্ডলের আক্রোশের একটা বড় উদাহরণ’।
একবার এক ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা নিয়েও অনুব্রতবাহিনীর (Anubrata Mondal) আক্রোশের শিকার হতে হয়েছিল বলে জানান বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য। সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ওরা পূর্বিতা (উপাচার্যের আবাসন) আক্রমণ করেছিল। সিসিটিভিতে দেখি, লাঠিসোটা নিয়ে অন্তত ২০০ জন বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে… ওরা মূল গেট ভেঙে দিয়েছিল। পুলিশকে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও পুলিশ পাত্তা দেয়নি… আমি সত্যি সেদিন ভয় পেয়েছিলাম… এরপর প্রায় রাত ১১:৩০ নাগাদ তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়জিকে ফোন করি। উনি এরপর মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করেন। তার ফলে পুলিশ এসে আমায় বাঁচায়। সেদিন জগদীপ ধনকড়জি হস্তক্ষেপ না করলে হয়তো আজ আমি জীবিত থাকতাম না’।
বিদ্যুৎবাবুকে এদিন জিজ্ঞেস করা হয়, এই ঘটনাগুলির সময় অনুব্রত মণ্ডলের প্রভাব ছিল, মাথায় শাসকদলের (Trinamool Congress) হাত ছিল। এখনও কি একই জিনিস রয়েছে বলে মনে হয়? জবাব আসে, ‘আপনি কি মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদ না থাকলে অনুব্রত মণ্ডলের এত সাহস হতো? অনুব্রত বীরভূমের ভোট করান। ওনার শাগরেদদের দেখলে আপনি শিউড়ে উঠবেন। উপাচার্য থাকাকালীন তাদের কিছু কার্যকলাপের নিদর্শন আমি দেখেছি। সেই ধরণের কার্যকলাপ সুস্থ মানুষ করে না। তাদের মধ্যে সবসময় একটা বিধ্বংসী মনোভাব ছিল। এই মনোভাবের পিছনে মদত ছিল অনুব্রত মণ্ডলের আর অনুব্রত মণ্ডলের পিছনে মদত ছিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর’।
তিহাড় যাওয়ার আগের অনুব্রত (Anubrata Mondal) এবং এই অনুব্রত একই বলে দাবি করেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য। তিনি বলেন, ‘এই অনুব্রতকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বীরের সম্মান দিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এই অনুব্রতকে মুখ্যমন্ত্রীর একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী বলেছিলেন বীরভূমের বাঘ। এরা জানে, বীরভূমের ক্ষেত্রে কিছু করতে হলে, অনুব্রতই শেষ কথা’।
এখানেই না থেমে বোলপুর থানার আইসির ফোন বাজেয়াপ্ত করা নিয়েও মুখ খোলেন বিদ্যুৎবাবু। বলেন, ‘লিটন হালদারের দু’টি ফোন নিয়ে নিয়েছে পুলিশ, অথচ অনুব্রত মণ্ডলের ফোন নিল না। এটা থেকে কি পরিষ্কার হয় না, নিশ্চয়ই ওপর মহল থেকে এর প্রতি সমর্থন আছে? ওপর মহল বলতে আমি মুখ্যমন্ত্রীকে বলছি। কারণ আমি মনে করি, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী চোখ দিয়ে দেখেন না, কান দিয়ে দেখেন। সেই কারণে আমার সম্বন্ধে উনি যে ধরণের বক্তব্য শুনেছেন, সেই ধরণের বক্তব্যের ভিত্তিতে উনি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন উনি নিশ্চয়ই অনুব্রত মণ্ডলের বক্তব্য শুনবেন এবং উনি দেখবেন অনুব্রত মণ্ডল কী ধরণের মানুষ!’ বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য বলেন, অনুব্রতর (Anubrata Mondal) ‘অডিও ক্লিপ’ ভাইরাল হওয়ার পর তৃণমূলকে সংশোধন করতে মুখ্যমন্ত্রী কোনও শক্ত পদক্ষেপ নেবেন বলে আমি আশা করছি।