বাংলা হান্ট ডেস্ক: কোনো ভালো কিছু করার জন্য প্রয়োজন হয় সদিচ্ছার। সেই ইচ্ছেকে সঙ্গে করে মানুষ চাইলেই করে ফেলতে পারে অসাধ্য সাধন। আর এই আপ্তবাক্যকেই ফের একবার প্রমাণ করে দেখালেন ইয়াসিন পাঠান (Yasin Pathan)। হাজারও প্রতিকূলতা চলার পথে এলেও তিনি তাঁর লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্য। বর্তমানে ইয়াসিনের সৌজন্যেই কার্যত নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে মেদিনীপুরের একাধিক মন্দির। একদিকে দেশজুড়ে যখন বিভিন্ন ধর্মীয় উষ্কানীমূলক ঘটনা ঘটছে ঠিক সেই আবহেই ইয়াসিন যেন সবাইকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছেন।
প্রাচীন মন্দিরের প্রাণ ফেরাচ্ছেন ইয়াসিন: ছোটবেলা থেকেই চরম দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে হয় ইয়াসিনকে। এমনকি শ্রমিক হিসাবেও কাজ করতে হয় তাঁকে। পরবর্তীকালে তিনি একটি স্কুলে কেরানি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে, তিনি প্রাচীন মন্দিরগুলিকে সংরক্ষণ করে সকলের মন জিতে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিজের সম্প্রদায়ের বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েও আজও ৬৯ বছর বয়সী ইয়াসিন তাঁর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন। তাঁর হাত ধরেই এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেদিনীপুরের একের পর এক ঐতিহ্যবাহী মন্দির।
১৯৯৪ সালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কবির পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পর ইয়াসিন পাঠানের কাজ সকলের কাছে একটি নতুন স্বীকৃতি পায়। মূলত, মেদিনীপুর শহরের কাছাকাছি পাথরা মৌজার গ্রামগুলিতে অষ্টাদশ শতকের ৩৪ টি মন্দির রয়েছে। সেগুলি পাথরা, বিন্দাপাথরা, রামতোতা, উপরডাঙ্গা, কাঁচ কলা এবং হাটগোড়ার মত এলাকায় বিস্তৃত রয়েছে। এমতবস্থায়, ইয়াসিন ওই প্রাচীন মন্দিরগুলিকে রক্ষা করার পাশাপাশি সেগুলির মেরামতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
দারিদ্রের মধ্যে কাটে জীবন: যৌবনকাল থেকেই ইয়াসিন এই মন্দিরগুলির সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি, তাঁর বাবার সাথে ওই বিষ্ময়কর মন্দিরগুলির কাছ থেকে যাতায়াতের সময় সেগুলির ধ্বংসাবশেষ দেখে ইয়াসিন অবাক হতেন। শুধু তাই নয়, সেগুলিকে রক্ষা করতে তিনি কিছু করতেও চেয়েছিলেন। এমতাবস্থায়, ইয়াসিন সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি যে কোনো মূল্যে এই মন্দিরগুলিকে রক্ষা করবেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া ইয়াসিন মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি, বড় হওয়ার পর ১০ ভাইবোনের দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওপর।
নিজের সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পান প্রতিবাদ: একটা সময়ে বাড়ির আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য ইয়াসিন শ্রমিকের কাজও করতেন। যদিও, কিছুদিন পর তিনি নিজ এলাকার একটি স্কুলে কেরানির চাকরি পান। ১৯৭১ সাল নাগাদ ইয়াসিন মন্দির সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন। পাশাপাশি, তিনি মন্দিরগুলিকে রক্ষা করারও সিদ্ধান্ত নেন। যদিও, তিনি ভাবেননি যে নিজের সম্প্রদায়ের কাছ থেকেই বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে তাঁকে! তবে কোনো প্রতিবন্ধকতাই ইয়াসিনের সিদ্ধান্তকে দুর্বল করতে পারেনি। বরং, তিনি তাঁর কাজ করে যেতে থাকেন।
এদিকে, সময়ের সাথে সাথে ইয়াসিন এবং তাঁর কাজের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তন হতে থাকে। তিনি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং জেলা প্রশাসনের কাছে দাবির মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, যে মন্দিরের সংস্কারের সময়ে যাঁদের জমিগুলি চলে আসছে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পাশাপাশি, এই অভিযানে তিনি গ্রামবাসীর সমর্থনও পেতে শুরু করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সংশ্লিষ্ট গ্রামের ৯০ শতাংশ পরিবারই হিন্দু। এমনকি, ইয়াসিনের মুসলিম অধ্যুষিত হালিহালকা গ্রামের লোকজনও তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। এমতাবস্থায়, ইয়াসিন মন্দিরের বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে জানান।
অবশেষে হাসিল করেন সফলতা: ইয়াসিন তাঁর লক্ষ্যপূরণের জন্য এতটাই মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলেন যে, তাঁর সেই কাজের রেশ পৌঁছে যায় তৎকালীন কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছেও। শুধু তাই নয়, ইয়াসিন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সাথে দেখা করেছিলেন এবং মন্দিরগুলি পুনরুদ্ধারের জন্য প্ল্যানিং কমিশনের কাছ থেকে ২০ লক্ষ টাকার দাবি করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর এই দীর্ঘ লড়াই সফলতা পায়। ২০০৩ সালের ১৬ জুলাই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া মন্দিরগুলির সংরক্ষণের কাজ শুরু করেন। জানিয়ে রাখি যে, সংস্কার করা ২৬ টি মন্দিরের মধ্যে ASI ১৯ টির দায়িত্ব নিয়েছে।