বাংলাহান্ট ডেস্কঃ নিজের বাল্যবেলায় জুটতো না দুবেলা দুমুঠো খাবার। ছিলনা ভালোও কোনও মাথা গোজার ঠাঁয়। তবে সেই সময় থেকেই নিজের মতই বাঁকি পাঁচটা শিশুদের নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল তার প্রবল। যখনই কোনও বিলাসবহুল অট্টলিকা দেখতেন, তখনই তার মনে জাগত তেমন এক স্বপ্নের বাড়ি বানানোর। তবে তা নিজের জন্য নয়, বাঁকি পাঁচটা গৃহহারা, অনাথ, অসহায় ও গৃহহীন বুড়ো বাবা-মাদের জন্য। নিজেই রাস্তায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় পড়ে থাকা সেই শিশু আজ অদম্য ইচ্ছাশক্তির দ্বারা বানিয়ে ফেলল একটা নন প্রফিট অর্গানাইজেশন। যার নাম ‘ থেরুভোরা প্রবর্তক অ্যাসোসিয়েশন’।
কথা হচ্ছে মরুকানের কথা। যে ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি ভবনে শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত তুলে নিয়েছেন পুরস্কার। সেদিন সেই যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছিল সেখানকার ঝকমকে আলো আর মিডিয়ার ভিড়ে লজ্জায় আর ভালোলাগায় সে কতটা আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল। তবে মনের মধ্যে অদ্ভুত ভালোলাগা আর অসহয়মানুষ গুলোর জন্য কিছু করতে পারার আনন্দে সেদিন মেরুকানের মুখ দিয়ে কোনও কথায় ফুটছিল না। সেই দুঃস্থ, অনাথ, অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার যে স্বপ্ন মেরুকান সেদিন দেখে ছিল, আজ তা বাস্তব রূপ পেয়েছে।
তবে পথে পড়ে থাকা সেই শিশুর বয়সের সাথে সাথে বেড়ে ওঠা আর শেষে নিজের স্বপ্নের চাবিকাঠি খুঁজে পাওয়ার মধ্যেকার পথ মোটেও সুগম ছিল না। এর জন্য তাঁকে নিরলস পরিশ্রম আর নিজের স্বপ্নের প্রতি একাগ্রতা বজিয়ে রাখতে হয়েছিল। জেনে নেওয়া যাক, তাঁর সেই দুর্গম যাত্রা সন্মন্ধে—-
মেরুকানের মা একটি চায়ের কারখানার অল্প বেতনে কাজ করতেন, আর সেই পয়সা টুকুও তাঁর বাবা মদ আর জুয়ায় উড়িয়ে দিতেন। তাই বাল্যবেলায় মেরুকানকে (Merukan) বেশিরভাগই একবেলা খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছিল। সেই ছোট্ট মেরুকানকে একদিন খালি পেটে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছিলেন সমাজকর্মী মাভুরিস (Mabhuris)। তখন তিনিই মেরুকানকে তুলে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজের ডন বস্কো স্নেহভবনে। তারপরই ছন্নছাড়া মেরুকানের জীবনে আসে আমূল পরিবর্তন। সেখান থেকেই সে জীবনকে নতুন করে শুরু করার আর নিজের স্বপ্নকে পূরণে প্রতিজ্ঞা হয় মেরুকান।
ওই স্নেনভবন থেকে চাইল্ড লাইনে কাজ করার পাশাপাশি বাইরে অন্যান্য কাজও করতে লাগে মেরুকান। সেখান থেকে যা স্বল্প আয় হত তাঁর, তা সে খরচ না করে বাঁচিয়ে রাখত। আর সেই বাঁচিয়ে রাখার টাকা ও ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একদিন কিনে ফেলে একটি অটো। আর সেই অটো চালাতে গিয়েই তাঁর জীবনে এসেছিল বড়সড় বিপত্তি। একদিন রাস্তায় একদল দুষ্কৃতীকে একটি পথশিশুকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিতে দেখে মেরুকান। তা বুঝতেই পেরেই তাদের পিছন ধাওয়া করে মেরুকান। দুষ্কৃতিরাও পরিস্থিতি বেগতিক দেখে শিশুটিকে ফেলে পালিয়ে যায়। পরের দিন সেই কুখ্যাত গ্যাং এসে মেরুকানের অটো ভেঙে চুরমার করে দিয়ে যায়। তবে শান্ত শিষ্ঠ স্বভাবের মেরুকান সেদিন কোনও হিংস্র পথ অনুসরণ করেননি।
পরে নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে, স্ত্রীকে বলেছিলেন ভালোবাসা ছাড়া তাঁকে আর কিছু দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। আর নিজের স্বপ্ন পূরণের কথা স্ত্রীকে জানাতেই, পাশে এসে দাড়াই ভালোবাসার মানুষটি। এমনকি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেরুকানের কর্মযজ্ঞে সামিল হয়েছিলেন স্ত্রী। নিজেও হাড়হিম করে অল্প কিছু উপার্জন করে স্বামীর কর্মযজ্ঞে সামিল সেই অর্থ তুলে দিয়েছিলেন মেরুকানের হাতে।
এভাবেই মেরুকান তাঁর স্ত্রী এবং আরও কিছু সহৃদয় মানুষের সঙ্গ পেয়ে একদিন নিজের স্বপ্নকে সত্যি করে তুললেন। বানিয়ে ফেলেছিলেন ‘থেরুভোরা প্রবর্তক অ্যাসোসিয়েশন’। এই নন প্রফিট অর্গানাইজেশন আজ প্রায় ৯০০০ অসহায়ের আশ্রয়স্থল। সেই থেরুভোরা আজ শুধু গোটা রাজ্যের আশ্রয়হীনদের আশ্রয় দেওয়াতে থেমে নেই, পুলিশ এবং হাসপাতাল গুলিতে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে অসুস্থ দের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে চলেছে। এই সংস্থা আজ সবসময় চেষ্টা করে চলেছে অন্ধকার জগৎ থেকে অসহায়দের তুলে এনে আলোর মুখ দেখাতে।