বাংলা হান্ট ডেস্ক: ২৬ জুলাই দিনটি প্রতিবছর পালিত হয় “কার্গিল বিজয় দিবস” হিসেবে। কারণ, ১৯৯৯ সালে আজকের দিনেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলা ভয়াবহ কার্গিল যুদ্ধে সফলতা লাভ করে ভারতীয় সেনা। এমতাবস্থায়, এই বিশেষ দিনে আজ আমরা এমন একজন “নায়ক”-এর প্রসঙ্গ আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করব যিনি পাঁচটি বুলেটের আঘাত পেয়েও থেমে না থেকে লড়ে গিয়েছিলেন দেশের জন্য। আর সেই কারণেই কোবরা দিগেন্দ্র কুমার (Digendra Kumar) মাত্র ৩০ বছর বয়সে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন কর্তৃক দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্ব পুরস্কার মহাবীর চক্রে ভূষিত হয়েছিলেন।
মূলত, কার্গিল যুদ্ধের সময়, তিনি তাঁর দলের সহায়তায় ৪৮ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করে দেশকে দুর্দান্ত সাফল্য এনে দেওয়ার পাশাপাশি পাঁচটি বুলেটের আঘাত পেয়েও পাকিস্তানি মেজরের শিরশ্ছেদের মাধ্যমে তোলোলিং চূড়া জয় করে তেরঙ্গা উত্তোলন করেছিলেন।
রাজস্থানে জন্ম, সামরিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা, রাজপুতানা রাইফেলসে ভর্তি: রাজস্থানের সিকার জেলার নিমকাথানা তহসিলের একটি গ্রামে জাঠ পরিবারে জন্ম নেওয়া দিগেন্দ্র শৈশব থেকেই সামরিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তাঁর দাদু ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁর বাবা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সাহসী সেনা। ১৯৪৭-৪৮ সালের যুদ্ধের সময় দিগেন্দ্রের বাবা শিবদন সিংয়ের চোয়ালে ১১ টি গুলি লেগেছিল। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। এমতাবস্থায়, পিতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দিগেন্দ্র কুমার ২ রাজপুতানা রাইফেলে যোগ দেন।
এদিকে, রাজপুতানা রাইফেলসে ভর্তি হওয়ার দুই বছর পরে অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে দিগেন্দ্র কুমারকে শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্সে পাঠানো হয়েছিল। সেই অপারেশন চলাকালীন, এক দিনেই দিগেন্দ্র সন্ত্রাসীদের হত্যা করার পাশাপাশি, শত্রুদের গোলাবারুদ ঘাঁটি ধ্বংস করে দেন এবং প্যারাট্রুপারদের তাদের দখল থেকে উদ্ধার করেন।
মূলত, যখন তিনি তাঁর জেনারেলের সাথে গাড়িতে যাচ্ছিলেন সেই সময়ে রাস্তায় একটি ব্রিজের নিচ থেকে কিছু এলটিটিই সন্ত্রাসবাদী জেনারেলের গাড়িতে একটি হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে মারে। তখনই দিগেন্দ্র সেই গ্রেনেডটি লুফে নিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। আর তারপরেই এই ঘটনা ঘটে।
কুপওয়ারায় এরিয়া কমান্ডারকে খতম করেন: কয়েক বছর পর তাঁকে কাশ্মীরের কুপওয়ারায় পাঠানো হয়। সেখানেও তিনি সন্ত্রাসবাদীদের কাজ বন্ধ করতে উদ্যত হন। এছাড়াও, তিনি এরিয়া কমান্ডার তথা জঙ্গি মজিদ খানকে খতম করেন। প্রায় এক বছর পর, ১১৯৩ সালে, দিগেন্দ্র কুমার হজরতবাল দরগাহকে সন্ত্রাসবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যার জন্য ভূয়সী প্রশংসাও পান তিনি। কিন্তু দিগেন্দ্রের কাছে এগুলো সবই ছিল ছোট অর্জন। বরং এই সাহসী এবং নির্ভীক যোদ্ধা তাঁর মাতৃভূমির জন্য বড় কিছু করতে চেয়েছিলেন। আর সেই সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন।
১৯৯৯ সালের মধ্যে, দিগেন্দ্র কুমার ওরফে কোবরা সেনাবাহিনীর অন্যতম সেরা কমান্ডো হিসেবে বিবেচিত হন। ওই বছরের ১৩ জুন যা ঘটেছিল তা দিগেন্দ্র কুমারকে স্মরণীয় করে তুলেছিল। তিনি ১৫,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত তোলোলিং-এর শীর্ষ পোস্টটি জিতেছিলেন। পাশাপাশি, সেখানে তেরঙ্গা উত্তোলনের মাধ্যমে, ভারত প্রথম বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য পায়। এই অভিযানের সময় তিনি পাঁচটি বুলেটের আঘাত পেলেও থেমে থাকেননি। বরং লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয়ে জয়ে হাসিল করেন।
পরিকল্পনা জানতে চেয়েছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মালিক: কার্গিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে, দিগেন্দ্রের ইউনিট ২ রাজপুতানা রাইফেলসকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কুপওয়ারা পৌঁছনোর এবং পরবর্তী ২৪ ঘন্টার মধ্যে যুদ্ধের ফ্রন্ট নিতে প্রস্তুত থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ভিপি মালিক এই বিষয়ে প্রস্তুতি সভা করেন। সেখানেই দিগেন্দ্র কুমার তাঁকে ওই চূড়ায় আরোহণের পরিকল্পনার ব্যাখ্যা দেন। জেনারেল মালিকের নির্দেশ অনুসারে দিগেন্দ্রকে ঘাতক দলের কমান্ডার করা হয়েছিল এবং মেজর বিবেক গুপ্তকে করা হয় কমান্ডিং অফিসার। ১২ জুন রাতের নিস্তব্ধতায় বরফের পাহাড়ে শীতের কাঁপুনি উপেক্ষা করে আরোহণ সম্পন্ন করেন তাঁরা। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে ১১ টি বাঙ্কার তৈরি করেছিল। যার মধ্যে প্রথম ও শেষ বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়েছিলেন দিগেন্দ্র কুমার।
শীর্ষস্থান দখল করা সহজ ছিল না: প্রথম বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়ে দিগেন্দ্র যখন রাতের আঁধারে শত্রুর বাঙ্কারে ঢুকে পড়েন, তখনই তা টের পেয়ে শত্রুরা গুলি চালায়। সেই সময় তাঁর চারটি গুলি লাগে। সেই সময় সহযোদ্ধাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আহত দিগেন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে ওই বাঙ্কারে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। এরপর পেছন থেকে অতর্কিত হামলায় বেশ কয়েকজন সেনা গুরুতর আহত হন। তারপর তাঁর দল সেই ৩০ জন আক্রমণকারীকে খতম করে দেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আনোয়ার খানের শিরশ্ছেদ: অন্যদিকে, দিগেন্দ্র কিছু সেনার সহযোগিতায় স্টেরয়েডযুক্ত ব্যথানাশক ইনজেকশনের ব্যবহার করতে থাকেন। তারপরই দিগেন্দ্র ও তাঁর দল পুরো ১১ টি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেন। এদিকে, ভোরের দিকে তাঁর সহযোগী সর্দার সুমের সিং রাঠোড়ও গুলিবিদ্ধ হন। এমতাবস্থায়, দিগেন্দ্র তাঁর এলএমজি নিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর আনোয়ার খানকে দেখতে পান। সেই সময়ে গুলির লড়াইর মাঝেই দিগেন্দ্র ফের গুলিবিদ্ধ হয়ে আনোয়ারের গলা চেপে ধরে ছুরি বের করে তাঁকে খতম করে দেন।
বাজপেয়ী করেন ভূয়সী প্রশংসা: ১৯৯৯ সালের ১৩ জুন, সময় ভোর সাড়ে ৪ টে। তোলোলিং-এর চূড়ায় তেরঙ্গা উড়তে থাকে গর্বের সাথে। যদিও, গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় দিগেন্দ্রকে। এমতাবস্থায়, এই বিরাট সাফল্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দিগেন্দ্রকে বাহবা দিয়ে জানান, “বাহ আমার কলিযুগের ভীম পুত্র, তুমি ৪৮ জনকে হত্যা করেছ। আরও দু’জনকে মারলে হাফ সেঞ্চুরি হয়ে যেত।” তবে এরপর, দিগেন্দ্র কুমারের চিকিৎসা আরও দুই-তিন বছর ধরে চলতে থাকে এবং পরে তিনি “আনফিট” ঘোষিত হয়ে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। তাঁর এই অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে মহাবীর চক্রেও সম্মানিত করেছে।